দানশীলতা একটি মহৎ গুণ। সমাজের দরিদ্র, অসহায় ও অভাবগ্রস্ত লোকদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করাকে দানশীলতা বলা হয়। দানশীলতার প্রতিশব্দ বদান্যতা, উদারতা ও মহত্ত ইত্যাদি। এটি মহান আল্লাহ ও মানুষের ভালোবাসা অর্জনের বিশেষ মাধ্যম। দানশীল ব্যক্তিকে সকলে ভালোবাসে এবং শ্রদ্ধা করে।
সমাজে বিভিন্ন ধরনের মানুষ বসবাস করে। কেউ ধনী আবার কেউ গরিব। ধনীদের উচিত গরিবদের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। সমাজের গরিব লোকদের প্রতি দানশীলতা ও বদান্যতা প্রকাশ করা একটি মহৎ কাজ। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এ ব্যাপারে বিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
'হে মু'মিনগন। আমি তোমাদেরকে যে জীবিকা দান করেছি তা হতে সেদিন আসার পূর্বেই ব্যয় করো যেদিন কোনো ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধুত্ব ও সুপারিশ নেই। আর অবিশ্বাসীরাই অত্যাচারী।' (সুরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৪)
দান করা একটি ফযিলতপূর্ণ কাজ। দানশীল ব্যক্তিকে আল্লাহ তা'আলা অফুরন্ত নেকি প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দানশীলতার ফযিলত বর্ণনা করে মহান আল্লাহ বলেন, 'যারা আল্লাহর পথে স্বীয় সম্পদ ব্যয় করে তাদের উপমা একটি শস্যবীজের ন্যায়; তা হতে উৎপন্ন হলো সাতটি শীষ, প্রত্যেকটি শীষে একশত শস্যদানা। আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা আরও বর্ধিত করে দেন, বস্তুত আল্লাহ হচ্ছেন প্রাচুর্যময় ও সর্বজ্ঞ।' (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৬১)
দানশীলতা মানুষকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকটবর্তী এবং জান্নাতেরও নিকটবর্তী। জাহান্নামের আগুন থেকে দূরবর্তী। এ প্রসঙ্গে মহানবি (সা.) বলেন, 'দানশীলতা জান্নাতের একটি বৃক্ষ। এর ডাল-পালা দুনিয়াতে ছড়িয়ে আছে। যে এর কোনো একটি ধারণ করবে তা তাকে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছে দিবে। আর কৃপণতা জাহান্নামের একটি বৃক্ষ। কেউ এর কোনো ডাল ধারণ করলে তা তাকে জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছে দিবে।' (বায়হাকী)
দানশীলতা মানুষের পাপ মোচন করে দেয়, মহান আল্লাহর ক্রোধকে মিটিয়ে দেয়। দান করলে বিপদ-আপদ দূর হয়। সম্পদ বৃদ্ধি পায় এবং পবিত্র হয়। মহান আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়া যায়। কেননা তিনি নিজেই দয়ালু ও দানশীল। তাইতো তিনি তাঁর সুন্দর নামসমূহের মধ্যে দয়ালু ও দাতা নাম দু'টি গ্রহণ করেছেন।
মানুষের মধ্যে সবচেয়ে দানশীল হলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। তাঁর দানের কোনো তুলনা করা সম্ভব নয়। তিনি ছিলেন মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠদাতা। তাঁর কাছে কেউ কিছু চেয়েছে আর তিনি জবাবে না বলেছেন, জীবনে এমনটি কখনো হয়নি। তিনি এমন পরিমাণ দান করতেন যে, দানগ্রহণকারী বিস্মিত হয়ে যেত। কোন প্রার্থনাকারীকে দেওয়ার মত কিছু না থাকলে তিনি তাকে পরে দেওয়ার ওয়াদা করতেন এবং সে ওয়াদা তিনি পূর্ণ করতেন। কখনও কখনও তিনি অনোর কাছ থেকে ঋণ নিয়েও দান করতেন।
মহানবি (সা.) এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সাহাবিগণও দানশীলতার সর্বোত্তম আদর্শ দেখিয়েছেন। তাঁরা মানুষের সহযোগিতায় সামর্থ্যের সবটুকু আল্লাহর রাস্তায় দান করেছেন। তাবুক অভিযানের সময় হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর সমুদয় সম্পদ দান করে দিয়েছিলেন। তাঁর দানে অভিভূত হয়ে মহানবি (সা.) বললেন, হে আবু বকরা তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য তুমি কী রেখে এসেছ? তিনি বললেন, তাদের জন্য অল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে রেখে এসেছি। হযরত আবু বকরের দানশীলতার এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল।
দান করার জন্য আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। দান প্রকাশ্যে করা যায় আবার গোপনেও করা যায়। তবে গোপনে দান করা উত্তম। দানের প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করার নিয়তে প্রকাশ্যে দান করা দোষের কিছু নয়।
কখনো কোনো সাহায্য প্রার্থনাকারীর সাথে খারাপ ব্যবহার করা উচিত নয়। কিছু দিতে না পারলেও তার সাথে হাসি মুখে কথা বলা উচিত। কেননা কারো সাথে হাসি মুখে কথা বলাও এক ধরনের সাদাকাহ। আবার দান করে খোঁটা দেওয়া যাবে না। এতে দানের ফযিলত নষ্ট হয়ে যায়।
আমরা দানশীলতার এই মহৎ গুনটি অর্জন করবো। সবসময় সাধ্যমতো দান করবো। দান করতে কখনও কার্পণ্য করবো না। সমাজ থেকে অভাব ও দারিদ্র্য দূর করতে ভূমিকা রাখবো।
দলগত কাজ শিক্ষার্থীরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে দানশীলতার ফযিলতগুলো আলোচনা করবে। |
মিতব্যয়িতা মানবচরিত্রের একটি প্রশংসনীয় গুণ। মিতব্যয় মানবজীবনকে সমৃদ্ধ করে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নিরাপত্তা আনে।
মিতব্যয়িতা মানে ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংযম ও সতর্কতা অবলম্বন করা। কিংবা 'আয় বুঝে ব্যয় করা'। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করাই হলো মিতব্যয়িতা। শুধু ব্যয়ের ক্ষেত্রে নয়; বরং কথাবার্তা, হাঁটা-চলায়ও ইসলামে মধ্যপন্থার নির্দেশ রয়েছে।
অপচয় ও কৃপণতা এই দুই প্রান্তিকতার মাঝখান হলো মিতব্যয়িতা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হওয়া জরুরি। মিতব্যয়িতার মাধ্যমেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব। তাই মানুষের জীনবযাত্রায় মিতব্যয়িতার গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রকৃত মুমিন ব্যক্তিরা খরচের ক্ষেত্রে অপচয়ও করেন না। আবার কৃপণতাও করেন না। তাঁরা নিজ প্রয়োজন মতো খরচ করেন। যাতে অন্যের কাছে হাত পাতা না লাগে। মিতব্যয়িতা মুমিন চরিত্রের অন্যতম গুণ।
মিতব্যয়ীকে আল্লাহ তা'আলা ভালোবাসেন। সকল ধর্মে মিতব্যয়কে উৎসাহিত করা হয়েছে। কার্পণ্য ও অপব্যয়কে নিন্দা করা হয়েছে। মিতব্যয় মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি করে এবং অন্যকে সাহায্য করার পথ উন্মুক্ত করে।
একদিকে প্রতিবছর বিশ্বে কোটি কোটি টন খাদ্য অপচয় হয়। অন্যদিকে বিশ্বে প্রতিদিন অনেক মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটায়। আর এই সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন মিতব্যয়িতা। আবার আমরা যদি সব জায়গায় বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস প্রভৃতি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হই। তাহলে এসব ক্ষেত্রে অপচয় নিয়ন্ত্রণ হবে। ফলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।
মিতব্যয়িতার সঙ্গে সঞ্চয়ের একটি বড় সম্পর্ক রয়েছে। জাতীয় উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো সে দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধি। মিতব্যয়িতার মাধ্যমে সঞ্চয় করে সম্পদ বৃদ্ধি করা যায়। সঞ্চয় যত বৃদ্ধি পাবে, দেশের অর্থনীতি তত সমৃদ্ধ হবে। পরনির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) মিতব্যয়িতার অভ্যাস তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কারণ মিতব্যয়ীকে আল্লাহ তা'আলা দারিদ্রাযুক্ত জীবন দান করবেন। রাসুলে কারিম (সা.) বলেন, 'যে ব্যক্তি পরিমিত ব্যয় করে সে নিঃস্ব হয় না'। (মুসনাদে আহমাদ)
মিতব্যয়িতার মাধ্যমে হালাল পন্থায় সঞ্চয় করে মানুষ অঢেল সম্পদের মালিক হতে পারে। ইসলাম এতে নিষেধ করে না; বরং সঞ্চিত অর্থ থাকলেই তো জনকল্যাণমূলক কাজ করা যায়। সদকায়ে জারিয়ার ধারা চালু করা যায়। আবার উদ্ধৃত অর্থ যখন নেসাব পরিমাণ হবে তখন যাকাতের মতো আরেকটি মহান ইবাদাতেরও সুযোগ মিলবে।
আমাদের প্রিয় নবি (সা.) ছিলেন মিতব্যয়িতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি তাঁর ও পরিবারের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যয় করতেন। অতিরিক্ত সম্পদ তিনি দান করে দিতেন। আমরা মুমিন-মুত্তাকিদের জীবনী থেকেও মিতব্যয়িতার শিক্ষা পাই। মিতব্যয়ী ব্যক্তিকে সুসংবাদ দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'সুসংবাদ ঐ ব্যক্তির জন্য যাকে ইসলামের দিকে হেদায়েত করা হয়েছে, তার প্রয়োজন মাফিক জীবনোপকরণ আছে এবং সে তাতে সন্তুষ্ট রয়েছে'। (তিরমিযি)
মিতব্যয়িতা মানুষকে লোভ-লালসা, অপচয়, অপব্যয়, কৃপনতা, অলসতা ও আরামপ্রিয়তা থেকে বাঁচিয়ে রাখে। তাই আমরা সবাই জীবনের সকল ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হব। তাহলে আমাদের জীবন হবে সুন্দর, সুখী ও সমৃদ্ধশালী।
একক কাজ/জোড়ায় কাজ তুমি জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কীভাবে দানশীলতা ও মিতব্যয়িতা অবলম্বন করবে তার একটি তালিকা তৈরি কর। (শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তুমি একক/জোড়ায় দৈনন্দিন জীবনে দানশীলতা এবং মিতব্যয়িতার প্রয়োগক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে লিখে উপস্থাপন করো।) |
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন এবং সম্মানজনক আচরণ করা মুমিনের জন্য অপরিহার্য। তাদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'যে অন্ধকে পথ ভুলিয়ে দেয় সে অভিশপ্ত'। (মুসনাদে আহমাদ)
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩' অনুসারে প্রতিবন্ধিতা অর্থ যেকোনো কারণে ঘটিত দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ীভাবে কোনো ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত বা ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা বা প্রতিকূলতা এবং উক্ত ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিগত ও পরিবেশগত বাধার পারস্পরিক প্রভাব, যার কারণে উক্ত ব্যক্তি সমতার ভিত্তিতে সমাজে পূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণে বাধাপ্রাপ্ত হন।
প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে কুসংস্কার প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত। যেমন, প্রতিবন্ধী শিশু বাবা মায়ের পাপ বা অভিশাপের ফল, প্রতিবন্ধী শিশুর ওপর জিনের প্রভাব আছে, প্রতিবন্ধী শিশুর জন্মের জন্য বাবা-মায়ের অসচেতনতা দায়ী, মায়ের দোষে এমন শিশুর জন্ম হয়, প্রতিবন্ধী শিশু পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য অভিশাপ ইত্যাদি। আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তার পরিবারকে উপহাস করা হয়। আল্লাহ তা'আলা এমন আচরণ নিষিদ্ধ করে বলেন,
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ عَسَى أَن يَكُونُوا خَيْرًا مِّنْهُمْ
وَلَا نِسَاءٌ مِّن نِّسَاءِ عَسَى أَن يَكُنَّ خَيْرًا مِنْهُنَّ
অর্থ: 'হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী অপর কোনো নারীকেও যেন উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে।' (সুরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১১) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে অভিভাবকের অনেক ভাবনা। প্রতিবেশীরা কী বলবে, আত্মীয়স্বজনরা কী ভাববে? এসব ভেবে তাদেরকে কখনোই ঘরের বাইরে নেওয়া হয় না। তাদেরকে ঘরবন্দি করে রাধা হয়। প্রতিবন্ধী শিশুর বিকাশ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য এসব কুসংস্কার দূর করতে হবে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মর্যাদা
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা মর্যাদা ও সম্মানের দাবিদার। আল্লাহ তা'আলার কাছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মর্যাদা অনেক বেশি। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরকে বিশেষ মর্যাদা দিতেন। তিনি মদিনার বাইরে গেলে অন্ধ সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমকে (রা.) মদিনার অস্থায়ী শাসক নিয়োগ করতেন। অন্ধ ব্যক্তিদের জন্য জান্নাতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'আমি যে ব্যক্তির দু'টি প্রিয় চোখ কেড়ে নিয়েছি, অতঃপর সে ধৈর্য ধারণ করেছে। সে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়েছে বলে মনে করে এবং সওয়াবের আশা করে, আমি তাকে জান্নাত ব্যতীত অন্য কোনো কিছু দিয়ে সন্তুষ্ট হব না'। (তিরমিযি)
ইসলাম প্রতিবন্ধী ও অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য শরিয়তের বিধিবিধান পালনে ছাড় দিয়েছে। প্রত্যেক ফরয বিধান তাদের সাধ্যের ওপর নির্ভর করবে। মহান আল্লাহ বলেন,
لا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا
অর্থ: 'আল্লাহ কারো ওপর এমন কোনো কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না যা তার সাধ্যাতীত।' (সুরা আল- বাকারা, আয়াত: ২৮-৬)
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার
প্রতিবন্ধীতা মানবজীবনের এক দুর্বিষহ অধ্যায়ের নাম। জন্মগত, দুর্ঘটনা কিংবা অসুস্থতা যে কারণেই হোক, ইসলাম সব ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সহযোগিতা করার নির্দেশ দিয়েছে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করতেন। রাসুলুল্লাহকে (সা.) অনুসরণ করে মুসলিম খলিফারাও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। তারা সমাজের অসহায়-প্রতিবন্ধী লোকদের নামের তালিকা করেন। প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত পরিমাণ ভাতার ব্যবস্থা করেন। প্রতি দু'জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির দেখভালের জন্য একজন খাদেম নিযুক্ত করেন। বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সেবাকেন্দ্র চালু করেন।
মুসলিম সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির দায়িত্ব নেওয়া ফরযে কেফায়া। রাষ্ট্র যদি এ দায়িত্ব পালন না করে বা দেশের কোনো নাগরিকই তাদের সেবায় এগিয়ে না আসে, তাহলে সমাজের প্রতিটি মুসলমান এর জন্য দায়ী ও গুনাহগার হবে। পরকালে এ জন্য কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কারও দয়া চায় না। অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। দক্ষতা অর্জন করে স্বনির্ভর হতে চায়। আমাদের উচিত তাদের ব্যাপারে সমাজে বিদ্যমান নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে দেওয়া। ইসলাম তাদের যে সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে তা নিশ্চিত করা।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। আমরা প্রতিবন্ধীদের ভালোবাসব এবং তাদের যথাযথ সম্মান ও সহযোগিতা করব।
রোগীর সেবা বলতে বুঝায়, রোগীকে দেখতে যাওয়া, খোঁজ-খবর নেওয়া, প্রয়োজনীয় সেবা-শুশ্রুষা করা, সাহায্য করা, সাহস যোগানো, নরম ও সদয় কথা-বার্তা বলা ইত্যাদি।
রোগীর সেবা করা সুস্থ ব্যক্তির কর্তব্য এবং সেবা প্রাপ্তি রোগীর অধিকার। হাদিসের আলোকে এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের প্রতি যে ছয়টি দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে তার মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে তার সেবা করা অন্যতম।
করার অর্থ প্রকৃতপক্ষে তার জীবন বাঁচাতে সাহায্য করা। একজন মানুষের জীবন বাঁচানোর চেয়ে উত্তম কাজ আর কিছুই হতে পারে না।
রোগীর সেবা করলে আল্লাহ তা'আলা খুশি হন। রোগীর সেবা করা মহান আল্লাহর সেবা করার শামিল। হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে, 'কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা আদম সন্তানকে সম্বোধন করে বলবেন, 'হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমার সেবা করোনি।' বান্দা বলবে, 'আপনি তো সারা বিশ্বের পালনকর্তা। আমি আপনাকে কীভাবে সেবা করতে পারি?' আল্লাহ বলবেন, 'আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল। তুমি তার সেবা করলে সেটা আমারই সেবা করা হতো।' (মুসলিম)
অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া মহানবি (সা.) এর আদর্শ। কেউ অসুস্থ হলে তিনি তাকে দেখতে যেতেন। রোগীর কপালে হাত রেখে স্নেহভরে খোঁজ-খবর নিতেন এবং তার আরোগ্যের জন্য দোয়া করতেন। জানতে চাইতেন, 'তোমার কি কিছু খেতে মনে চায়?' রোগী কোনো খাবারের কথা বললে তিনি দ্রুত তার ব্যবস্থা করতেন।
অমুসলিম কেউ অসুস্থ হলেও তিনি তাকে দেখতে যেতেন। একবার এক ইহুদি বালক অসুস্থ হয়ে পড়লো। মহানবি (সা.) তাকে দেখতে গেলেন। তার মাথার কাছে বসে অত্যন্ত মমতার সাথে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। বালকটি তখন ইসলাম গ্রহণ করলো। তখন মহানবি (সা.) বললেন, 'সকল প্রশংসা অল্লাহর জন্য, যিনি এই যুবককে জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন।' (বুখারি)
একবার মহানবি (সা.) এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হাসান (রা.) খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হযরত আবু মুসা আশ'আরী (রা.) তাঁকে দেখার জন্য আসলেন। তখন হযরত আলী (রা.) বললেন, 'কোনো মুসলিম সকালবেলা কোনো রোগীকে দেখতে গেলে সত্তর হাজার ফেরেশতা তার সাথে রওয়ানা দেয়। প্রত্যেক ফেরেশতাই সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করতে থাকে। তার জন্য জান্নাতে একটি বাগানও তৈরি করা হয়। আর সে যদি সন্ধ্যাবেলা কোনো রোগীকে দেখতে বের হয়, তাহলে সত্তর হাজার ফেরেশতা তার সাথে রওয়ানা দেয়। প্রত্যেক ফেরেশতাই সকাল পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করতে থাকে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান বরাদ্দ করা হয়'। (আবু দাউদ)
তবে রোগী দেখতে গিয়ে বেশি সময় রোগীর কাছে অবস্থান করা উচিত নয়। এতে রোগী ক্লান্ত হয়ে যায়। তার পরিবারেরও কষ্ট হয়। তবে প্রয়োজন থাকলে বা রোগী কিংবা তার পরিবার অগ্রহী হলে দীর্ঘ সময় অবস্থান করাতে কোনো দোষ নেই। রোগীকে খুশি করতে বারবার দেখতে যাওয়া উত্তম। রোগীর গায়ে হাত রাখা এবং তার আরোগ্যের জন্য দু'আ করা সুন্নাত। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো রোগী দেখতে যেতেন, তখন ডান হাত দিয়ে রোগীর কপাল স্পর্শ করতেন এবং বলতেন, 'হে মানুষের প্রভু! রোগ-শোক দূর করুন, আরোগ্য দিন, আপনি আরোগ্যদাতা, আপনার আরোগ্য ছাড়া কোনো আরোগ্য নেই, যা কোনো রোগকে অবশিষ্ট রাখে না' (বুখারিও মুসলিম)। রোগীর সেবা করা ও তাকে দেখতে যাওয়ার সময় উপর্যুক্ত বিষয়সমূহের দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা উচিত।
সুতরাং কেউ অসুস্থ হলে আমরা স্বেচ্ছায় তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবো। তার সেবা-শুশ্রুষা করবো। বিশেষ করে যারা অসহায়, অনাথ ও দরিদ্র, তাদের চিকিৎসার খোঁজ-খবর নিবো। তাদের পুষ্টিকর খাবার ও প্রয়োজনীয় ঔষধ দিয়ে সহায়তা করবো। আশাব্যঞ্জক কথা বলে তাদের মনকে প্রফুল্ল রাখবো। তাহলেই রোগীর প্রতি আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব হবে।
প্রতিফলন ডায়েরি লিখন
নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন অন্যতম মহৎগুণ। মর্যাদার দিক থেকে নারী-পুরুষকে ইসলাম আলাদা করেনি। ইসলাম নারী জাতিকে যথাযথ অধিকার, সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করেছে। সম্মানের সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন হলো নারী জাতির প্রতি উত্তম আচরণ করা, তার প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করা।
ইসলামে নারীর সম্মান ও মর্যাদা
নারীর মর্যাদা বলতে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নারীর যথার্থ মূল্যায়নকেই বুঝানো হয়। ইসলাম নারীকে প্রত্যেক ক্ষেত্রে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে। কেননা ইসলাম পূর্ব যুগে নারী ছিল সবচেয়ে অবহেলিত, লাঞ্চিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত। সে সময় নারীদেরকে মানুষ হিসাবে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হতো না। তাদের সামাজিক অধিকার স্বীকৃত ছিল না। তাদের প্রতি খুবই কঠোর আচরণ করা হতো। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কন্যা সন্তানকেও জীবন্ত কবর দিত। কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়া অমর্যাদার প্রতীক মনে করা হতো।
ইসলাম মা হিসেবে নারীকে সন্তানের কাছে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান করেছে। একদিন জনৈক সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল। আমার নিকট কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বললেন, অতঃপর কে? রাসুল (স.) বললেন, তোমার মা। সাহাবি বললেন, অতঃপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সাহাবি বললেন, অতঃপর কে? তিনি বললেন, অতঃপর তোমার পিতা। (বুখারি) এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, সন্তানের উপর পিতার চাইতেও মাতার অধিকার তিন গুণ বেশি। এটি মা হিসেবে নারীর অনন্য মর্যাদার পরিচায়ক।
কন্যা হিসেবেও নারীর মর্যাদা অপরিসীম। কন্যাদের ভালোভাবে প্রতিপালনের জন্য ইসলাম নির্দেশ প্রদান করেছে। মহানবি (সা.) বলেছেন, 'মেয়ে শিশু বরকত (প্রাচুর্য) ও কল্যাণের প্রতীক'। হাদিসে আরও আছে, 'যার তিনটি, দুটি বা একটি কন্যা সন্তান থাকবে; আর সে ব্যক্তি যদি তার কন্যা সন্তানকে সুশিক্ষিত ও সুপাত্রস্থ করে, তার জান্নাত নিশ্চিত হয়ে যায়'। (তিরমিযি)
ইসলাম স্ত্রী হিসেবে নারীকে যথাযথ মর্যাদা দিয়েছে। মহানবি (সা.) বলেছেন, 'উত্তম স্ত্রী সৌভাগ্যের পরিচায়ক'। (মুসলিম) তিনি আরও বলেন, 'তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম'। (তিরমিযি) স্ত্রী হিসেবে নারীর মর্যাদা ও সম্মান স্বামীর অনুরূপ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, 'নারীদের ওপর যেমন অধিকার রয়েছে পুরুষের, তেমনি রয়েছে পুরুষের ওপর নারীর অধিকার'। (সুরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৮)
অনেক পরিবারে মনে করা হয় পরিবারের ছেলেরা 'বংশের বাতি', তারা মা-বাবাকে রোজগার করে খাওয়াবে, দেখাশোনা করবে আর মেয়েরা তো চলে যাবে পরের বাড়ি। কাজেই খাওয়া-দাওয়া, লেখাপড়া সব ব্যাপারেই সকলের মনোযোগ থাকে ছেলেদের প্রতি। ইসলাম এমন আচরণ করতে নিষেধ করেছে। মহানবি (সা.) ঘোষণা করেন, 'কোনো ব্যক্তির ঘরে কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে সে যদি তাকে জীবন্ত কবর না দেয়, তাকে (শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে) অবজ্ঞা না করে এবং তার পুত্র সন্তানকে তার ওপর প্রাধান্য না দেয় তাহলে আল্লাহ তা'আলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন'। (আবু দাউদ)
নারীদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করা মুমিনের নিদর্শন। নারীর প্রতি সম্মানবোধ না থাকলে ইমান পূর্ণ হয় না। নারীদের সাথে উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা যায়। কুরআন ও হাদিসে এ ব্যাপারে মুমিনদেরকে নানা নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) স্ত্রীদের প্রতি ভালো ব্যবহারকারীদের উত্তম উম্মত হিসেবে বর্ণনা করে বলেন-
خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِأَهْلِهِ
অর্থ: 'তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম'। (তিরমিযি)
অন্য একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'নিশ্চয়ই ঐ ব্যক্তি পূর্নাঙ্গ মুমিন হবে। যে তাদের মধ্যে উত্তম চরিত্রের অধিকারী ও নিজ পরিবারের প্রতি অধিক সদয়'। (তিরমিযি)
ইসলাম নারীর মর্যাদার স্বীকৃতিস্বরূপ বিবাহের ক্ষেত্রে মহর প্রদান অপরিহার্য করেছে। কিন্তু অনেক মুসলিম মহর আদায় করে না। আবার কেউ আংশিক আদায় করে। আবার কেউ যৌতুক গ্রহণ করে। যা ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই গর্হিত কাজ। মহর আদায়ের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেন,
وأتوا النِّسَاءَ صَدُقَتِهِنَّ نِحْلَةً
অর্থ: 'আর তোমরা নারীদেরকে তাদের মহর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রদান করবে।' (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ৪)
ইসলাম নারীকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিয়ে সম্মানিত করেছেন। কিন্তু আমাদের সমাজে নারীদেরকে তাদের উত্তরাধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি করা হয়। কেউ আংশিক সম্পত্তি দেন। কেউ সামান্য কিছু টাকা পয়সা দিয়ে সমস্ত সম্পত্তি লিখে নেয়। কেউ বাড়ি, গাড়ি, স্বর্ণ অলংকার, নগদ টাকা দিতে চায় না। মনে করে নারীরা অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হয় না। আবার কেউ সম্পূর্ণ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে। এটা নারীদের ওপর সবচেয়ে বড় যুলুম, যা ইসলাম কখনও সমর্থন করে না। ইসলাম নারী পুরুষকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার বানিয়েছে নির্দিষ্ট অংশের ভিত্তিতে। আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'পিতামাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং পিতামাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে, তা অল্পই হোক অথবা বেশিই হোক, এক নির্ধারিত অংশ'। (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ৭)
পূর্ণাঙ্গ নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি অর্জনের জন্য নারীর প্রতি সম্মানবোধ থাকা আবশ্যক। অন্তর থেকে নারীদের সম্মান করতে হবে। পাশাপাশি নিজ আচরণ ও কর্ম দ্বারাও এর প্রমাণ দিতে হবে। এতে আল্লাহ তা'আলা সন্তুষ্ট হবেন। তাহলে আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করতে পারব।
দলগত কাজ আমি আমার পরিবার, প্রতিবেশি, বিদ্যালয়ে নারীদের যে যে উপায়ে সম্মান প্রদর্শন করবো। শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তুমি/তোমরা একটি তালিকা তৈরি করো। | ||
যে ক্ষেত্রে সম্মান করবো | যাকে সম্মান করবো | যে উপায়ে সম্মান করতে পারি |
পরিবার | মা, বোন | গৃহের কাজে সহায়তা করবো |
প্রতিবেশি | ||
বিদ্যালয়ে |
দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা মানুষের সহজাত স্বভাব। সকল ধর্মের লোকই তাদের দেশকে ভালোবাসে। মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি মানুষের এই ভালোবাসাকে ইসলাম কেবল সমর্থনই করে না; বরং একজন প্রকৃত মুমিনকে এগুলো ধারণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। যেমন আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেক রাসুলকেই স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছেন। মাতৃভূমি ও জন্মস্থানের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, মায়া-মমতা ও আকর্ষণই হলো দেশপ্রেম। এ ভালোবাসা মানুষের অন্তর থেকে আসে। আজীবন মানুষ এ আকর্ষণ ও ভালোবাসা অনুভব করে।
দেশপ্রেমের উপায়
দেশের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে। কারণ তিনিই আমাদেরকে স্বাধীন ও সার্বভৌম ভূখণ্ড দান করেছেন। যাঁরা স্বাধীনতা অর্জনে ত্যাগ ও অবদান রেখেছেন, তাঁদের প্রতি সম্মান জানানো, তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করা এবং তাঁদের জন্য দোয়া করা আমাদের কর্তব্য।
নাগরিকের প্রধান দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের সংবিধান, প্রচলিত আইন ও বিধি মেনে চলা, নিয়মিত 'কর' পরিশোধ করা এবং তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করা। এছাড়াও ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করা, নিজস্ব কৃষ্টি ও মূল্যবোধ চর্চা করা, রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার মাধ্যমে দেশপ্রেমিক হওয়া, সন্ত্রাস, হানাহানি, মারামারি ও বিশৃঙ্খলা না করা দেশপ্রেমের অংশ।
একজন প্রকৃত মুমিন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হয়ে থাকেন। তাই ইসলামের আলোকে দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ মানুষকে স্বদেশ রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে। কারণ স্বদেশকে হেফাযত করতে না পারলে ধর্মকে হেফাযত করা যায় না। দেশের মানুষ ও তাদের স্বার্থকে সংরক্ষণ করা যায় না।
দেশের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রতিবেশ রক্ষা করা একজন দেশপ্রেমিক নাগরিকের নৈতিক দায়িত। রাসুলুল্লাহ(সা.) বলেন, 'কিয়ামত হয়ে যাবে এটা যদি আগেভাগে অনুমান করতে পারো, তাহলেও হাতে রক্ষিত গাছের চারা রোপন করে দাও।' (আদাবুল মুফরাদ)
জনস্বার্থ বিরোধী কাজ হলো দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, খাদ্যে ভেজাল, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, খাদ্যে ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশানো ইত্যাদি। দেশপ্রেমিক নাগরিক এসব কাজ থেকে বিরত থাকবে এবং এসব কাজ প্রতিরোধে সচেষ্ট থাকবে।
দেশপ্রেসের গুরুত্ব
মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা ইসলামি মূল্যবোধের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কোনো দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে না পারলে মান-সম্মান, স্বাধিকার, ইমান ও আমল হেফাযত করা অসম্ভব। এজন্য ধর্মীয় দৃষ্টিতে দেশপ্রেমের গুরুত্ব অত্যধিক।
মক্কা থেকে বিদায়ের সময় রাসুল (সা.) বলেছিলেন, 'ভূখণ্ড হিসেবে তুমি কতই না উত্তম, আমার কাছে তুমি কতই না প্রিয়। যদি আমার স্বজাতি আমাকে বের করে না দিত, তবে কিছুতেই আমি অন্যত্র বসবাস করতাম না' (তিরমিযি)। হিজরত করে মদিনায় গমন করার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রায়ই মক্কায় ফিরে যেতে ব্যাকুল হয়ে পড়তেন। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে সান্তনা দিয়ে বলেন, 'যিনি আপনার জন্য কুরআনকে জীবনবিধান বানিয়েছেন, তিনি আপনাকে অবশ্যই আপনার জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনবেন।' (সুরা কাসাস, আয়াত: ৮৫)
সাহাবায়ে কেরাম (রা) স্বদেশকে ভালোবাসতেন। হিজরত করে মদিনায় যাওয়ার পর আবু বকর (রা.) ও বেলাল (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হলেন। তখন তাদের মনেপ্রাণে মক্কার স্মৃতিগুলো ভেসে উঠেছিল। সে সময় তারা মক্কার দৃশ্যাবলি স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি শুরু করলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের মনের এ অবস্থা দেখে প্রাণভরে দোয়া করেন, 'হে আল্লাহ! আমরা মক্কাকে যেমন ভালোবাসি, তেমনি তার চেয়ে বেশি মদিনার ভালোবাসা আমাদের অন্তরে দান কর'।
জীবনে সফলতা অর্জন প্রত্যেকেরই লক্ষ্য থাকে। দেশপ্রেম সফলতা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। মাতৃভূমি মানুষের জন্য শান্তির আশ্রয়। মাতৃভূমির পরশে যে প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া যায় তা অনন্য। কোনো সফর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে উহুদ পাহাড় চোখে পড়লে নবিজি (সা.)-এর চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠতো। তিনি বলতেন, 'এই উহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও উহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি।' (বুখারি ও মুসলিম) সুতরাং আমরা দেশকে ভালোবাসবো। ঐক্যবদ্ধ থেকে দেশের কল্যাণে অবদান রাখবো।
শালীনতার শাব্দিক অর্থ মার্জিতকরণ, সংশোধন করা, পরিশোধন, লজ্জাশীলতা, বিনম্রতা, ভদ্রতা, বেশ, ভূষা, কথাবার্তা ও আচার-আচরণে মার্জিত হওয়া। যে আচার আচরণ, কথা বার্তা, চলাফেরা ও পোশাক-পরিচ্ছদে ভদ্র, সভ্য, বিনম্ন মার্জিত ও সুরুচির পরিচয় পাওয়া যায় তাকে শালীনতা বলা হয়। শালীনতা একক কোনো গুণের নাম নয়। এর পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। অনেক গুণের সম্মিলিত রূপ শালীনতা। অশ্লীলতা, লজ্জাহীনতা, উগ্রতা, অহংকার কদর্যতা ইত্যাদি শালীনতার বিপরীত।
শালীনতার গুরুত্ব
শালীনতা ইসলামি সমাজ ব্যবস্থার মূলভিত্তি। একটি সুন্দর সমাজ গঠনে শালীনতার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই ইসলাম মানুষকে মার্জিত, রুচিশীল, নম্র-ভদ্র ও শালীন হওয়ার শিক্ষা দেয়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ আমাদের শালীনতার শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত লোকমান তাঁর পুত্রকে শালীনতার যে উপদেশ দিয়েছিলেন পবিত্র কুরআনে তা উল্লেখ আছে। তিনি বলেছিলেন, 'অহংকার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না। পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে চলো না, কারণ আল্লাহ কোনো উদ্ধত-অহঙ্কারী ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না।' (সূরা লুকমান, আয়াত: ১৮)
মানুষের মধ্যকার সকল প্রকার পাশবিকতা ও কুপ্রবৃত্তিকে অবদমিত করার জন্য শালীনতা একান্ত অপরিহার্য। কেননা অশালীন আচার-আচরণ ও বেশ-চুষা মানুষের মধ্যকার সুপ্ত কুপ্রবৃত্তিসমূহকে জাগিয়ে তোলে। তখন মানুষ যে কোনো অসৎ ও অন্যায় কাজ করতে দ্বিধা করে না। শালীনতার চর্চার মাধ্যমেই এসব অন্যায় থেকে বিরত থাকা সম্ভব।
শালীনতা মানুষকে পাপাচার থেকে পূতঃপবিত্র রাখে। কেননা অশালীনতা, অশ্লীলতা ও লজ্জাহীনতা সমাজে পাপের দুয়ার খুলে দেয়। ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সুরা আহযাবে শালীনতা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। নারী পুরুষের দৃষ্টি সংযত রাখতে বলেছেন।
শালীনতার অন্যতম দিক হলো লজ্জাশীলতা। লজ্জাশীলতা মানুষকে শালীন হতে সাহায্য করে। মহানবি (স.) বলেন 'তোমার যদি লজ্জাই না থাকে তাহলে তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারো'। (বুখারি) তিনি আরও বলেন
الْحَيَاءُ خَيْرٌ كُلَّهُ
অর্থ: 'লজ্জাশীলতার পুরোটাই কল্যাণময়'। (মুসলিম)
লজ্জাশীলতা ঈমানেরও অঙ্গ। তাই একজন মুমিন অবশ্যই ভদ্র, লজ্জাশীল ও মার্জিত হবেন। যেমন মহানবি (স.) বলেন-
الْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الْإِيْمَانِ
অর্থ: 'লজ্জাশীলতা ইমানের একটি শাখা।' (নাসাঈ)
কারো আচার-আচরণ মার্জিত হলে সবাই তাকে ভালোবাসে। অন্যদিকে কারো আচরণ, কথাবার্তা অথবা পোশাক-পরিচ্ছদ অশালীন হলে কেউই তাকে ভালোবাসে না। সবাই তাকে খারাপ মনে করে। এজন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'অশ্লীলতা যেকোনো জিনিসকে খারাপ করে এবং লজ্জাশীলতা যেকোনো জিনিসকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে।' (তিরমিযি)
শালীনতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মার্জিত ও রুচিশীল পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করা। শালীনতার জন্য শালীন পোশাক অপরিহার্য। শালীনতাপূর্ণ জীবনাচারণে সমাজ উন্নত হয়। পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে অশোভন আচরণ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করে, নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় ঘটায়।
অশালীন ব্যক্তিকে কেউ পছন্দ করে না। মহানবি (সা.) বলেন, 'মানুষের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে নিকৃষ্ট, যার অশ্লীলতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লোকেরা তাকে পরিত্যাগ করে।' (বুখারি) এমন মানুষকে আল্লাহ তা'আলাও পছন্দ করেন না। হাদিসে এসেছে, 'নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা'আলা অশালীন ও দুশ্চরিত্র ব্যক্তিকে ঘৃণা করেন। (তিরমিযি)
সুতরাং আমরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শালীনতার চর্চা করবো। কথা-বার্তা, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার কোনো কিছুতেই যেন উগ্রতা, অশ্লীলতা, অশালীনতা প্রকাশ না পায় সেদিকে খেয়াল রাখবো। তাহলেই আমাদের জীবন সুন্দর ও সার্থক হবে। সকলে আমাদের ভালোবাসবে। আর সমাজেও সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করবে।
প্যানেল আলোচনা |